রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। স্টেশন থেকে শেষ ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। পরের ট্রেনটা ভোরে।
বহুদিন পর বাড়ি ফিরছে রজত। অফিসের কাজের চাপে, শহরের কোলাহলে, নিজেকেই যেন হারিয়ে ফেলেছে সে।
আর আজ?
আজ হঠাৎ মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে। সেই ভাতের গন্ধ, বারান্দায় বসে লুঙ্গি পরে পেপার পড়া বাবার ডাক— “চা আছে তো?”
সব যেন খুব দূরের কোনো ছবি।
স্টেশনের একটা পুরোনো বেঞ্চিতে বসে আছে রজত। হাতে ফোন, কিন্তু ইন্টারনেট নেই। চারপাশ নিস্তব্ধ। কেবল বাতির টিমটিমে আলো আর দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের ডাক।
তখনই হঠাৎ—
“এই যে... আপনি?”
রজত চমকে তাকাল।একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে।
সাদা শাড়ি, খোলা চুল, চোখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। কোনো ভয় নেই, কোনো শব্দ নেই।
“এই রাতে আপনি এখানে?”
রজত একটু দ্বিধায় পড়ে গেল।
“আসলে… শেষ ট্রেনটা মিস হয়ে গেছে। আপনি?”
মেয়েটি হালকা হাসল। “আমি এখানে থাকি… প্রত্যেক রাতে। প্ল্যাটফর্মটার সঙ্গে যেন একটা আত্মীয়তা আছে আমার।”
রজত একটু হেসে বলল, “আসলে এই প্ল্যাটফর্মটা সত্যি অন্যরকম। খুব চেনা লাগে যেন। আপনি এখানে একা থাকেন না তো?”
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“একজনকে খুঁজতাম… অনেকদিন আগে। এখন আর খুঁজি না। এখন শুধু যারা পথ হারিয়ে ফেলে, তাদের একটু ফিরিয়ে দিই। কেউ তো না কেউ থাকা দরকার, তাই না?”
রজতের শরীরে হালকা শিরশিরে ভাব এলো।
তবুও তার কৌতূহল বাড়ছিল।
“আপনার নাম?”
“মেঘলা।”
নামটা উচ্চারণ করতেই যেন হাওয়ার ঝাপটা লাগল মুখে।
রজতের কানে এল মেয়েটি বলছে—
“তুমি ফিরে যাও, রজত। কাল সকালে তোমার মা তোমার জন্য অনেক কিছু রেঁধেছেন। একসাথে খাবে না?”
রজত চমকে উঠল।
“তুমি… তুমি জানলে কী করে?”
মেঘলা হালকা হেসে বলল,
“আমরা যারা রাতে জেগে থাকি, তারা অনেক কিছু দেখি। অনেক কিছু জানি। এখন যাও।”
আর কিছু বলার আগেই, চোখের পলকে… মেঘলা নেই।
চারপাশ ফাঁকা। বাতাস স্তব্ধ।
রজত উঠে দাঁড়াল। ঘোরের মধ্যে হাঁটছিল সে, এমন সময় একটা ট্রেন শব্দ করে এসে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মে।
কোনো ঘোষণা নেই।
কিন্তু একটা জানালার পাশে বসা গার্ড হাত দেখিয়ে বলল—
“বেলঘড়িয়া যাবে। উঠবেন?”
রজত কিছু না ভেবে উঠে পড়ল।
ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে লাগল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রজতের মনে হচ্ছিল, যেন সেই মেয়েটা… “মেঘলা”… এখনও কোথাও আছে।
হয়তো ছিল না।
হয়তো সে রাত, সে ট্রেন, সেই মেয়ে—সবই কল্পনা।
তবুও কিছু সত্য মনের গহীনে গেঁথে যায়।
ভোরবেলা, রজতের মা দরজা খুলে দেখলেন—রজত দাঁড়িয়ে, মুখে এক চিলতে হাসি।
“চা আছে তো?” — বলে ভিতরে ঢুকে গেল সে, যেন কিছুই বদলায়নি।
ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল ভোরের আলো।
রজত চুপচাপ বসে রইল একমুঠো চায়ের কাপ হাতে।
তবে তার চোখের কোণে জমে ছিল অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি—
ভয় নয়, বিস্ময় নয়… যেন কোনো পরিচিত মুখের সঙ্গে দেখা হয়েছে, বহু বছর পর।
সে জানে—সব কিছু হয়তো বাস্তব ছিল না।
কিন্তু একটাই সত্য—সে ফিরেছে। ঠিক সময়মতো।
আর সেই রাতটা?
কেউ তাকে হয়তো পথ দেখিয়ে দিয়েছিল… নিঃশব্দে।
নৈতিক শিক্ষা
আমরা জীবনের দৌড়ে ছুটতে ছুটতে ভুলে যাই—
কিছু মানুষ শুধু আমাদের জন্য অপেক্ষা করে।
তারা চায় না কিছু, শুধু একটুখানি দেখা, একটুখানি কথা।
কিন্তু সময়—
সে অপেক্ষা করে না।
শেষ ট্রেন চলে গেলে প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হয়ে যায়।
তখন কেউ একজন পিছনে ফেলে আসা পথে দাঁড়িয়ে কাঁদে… নিঃশব্দে।
👉 এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
প্রিয়জনের ভালোবাসাকে অবহেলা কোরো না।
কারণ অনেক সময় ফেরার দরজা খোলা থাকে,
কিন্তু ডাক দেওয়া মানুষটা আর থাকেন না।
